মানবসভ্যতাকে একজন মুসাফিরের সাথে তুলনা করা যেতে পারে, যাকে তার মালিক প্রেরণ করেছেন। যে সফরের একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও গন্তব্য রয়েছে। মালিক সফরের সকল পাথেয়র ব্যবস্থা করেছেন। পথ দেখানোর জন্য রাহবারের এন্তেজাম করেছেন। অন্ধকারে চলার জন্য আলো দান করেছেন। কিন্তু সে তার এ সফরে বারবারই পথ হারিয়েছে। রাহবারের দেখানো পথে হাঁটেনি। মালিকের দেওয়া আলো জ্বেলে রাখতে পারেনি, অন্ধকারে তার দ্বারা উপকৃত হতে পারেনি। বারবারই খাদের কিনারায় পৌঁছেছে। নিজেকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়েছে। কিন্তু মালিক তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। আবারও রাহবার প্রেরণ করেছেন, বারবার আলোর ব্যবস্থা করেছেন, যেন সে তাঁর গন্তব্যে পৌঁছতে পারে, নিজেকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। সেই ধারাবাহিকতায় মালিকের প্রেরিত রাহবার যখন দুনিয়া ত্যাগ করেছেন, তার রেখে যাওয়া মশালের আলো যখন নিভুনিভু করছে- রাস্তা তো দূরের কথা সে আলোতে মুসাফির নিজেকে পর্যন্ত চিনতে পারছে না। পথহারা, ক্ষত-বিক্ষত সে মুসাফির মৃতপ্রায় অবস্থায় ধ্বংস গহ্বরের খাদে শেষক্ষণ গুনছে। যে কোনো মুহূর্তে তার লীলা সাঙ্গ হতে পারে। ইসলামপূর্ব জাহিলিযুগকে এক কথায় প্রকাশ করলে উল্লেখিত মুসাফিরই হবে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন,وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا

অর্থ: তোমরা তো অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তে ছিলে, আল্লাহ তা হতে তোমাদের রক্ষা করেছেন। [সূরা আলে ইমরান-১০৪]
কিন্তু আল্লাহ তাআলা তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। আবারও রাহবার প্রেরণ করেছেন, অন্ধকারে আলোর ব্যবস্থা করেছেন। তার শরীরে ছড়িয়ে পড়া প্রতিটি রোগ নিরাময়ে চিকিৎসা প্রদান করেছেন। যেন আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারে, সঠিক পথে এগিয়ে যেতে পারে, তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে।
কুরআনে বিষয়টি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে :الر .كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِ رَبِّهِمْ إِلَى صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ

অর্থাৎ, আলিফ-লাম-রা, এই কিতাব, এটি তোমার প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে, যাতে তুমি মানবজাতিকে তাদের প্রতিপালকের নির্দেশক্রমে বের করে আনতে পার অন্ধকার হতে আলোতে। [সূরা ইবরাহিম- ১]

هُوَ الَّذِي يُنَزِّلُ عَلَى عَبْدِهِ آيَاتٍ بَيِّنَاتٍ لِيُخْرِجَكُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَإِنَّ اللَّهَ بِكُمْ لَرَءُوفٌ رَحِيمٌ

অর্থাৎ, তিনিই তাঁর বান্দার প্রতি সুস্পষ্ট আয়াত অবতীর্ণ করেন, তোমাদেরকে অন্ধকার হতে আলোতে আনার জন্য। আল্লাহ তো তোমাদের প্রতি করুণাময়, পরম দয়ালু। [সুরা হাদিদ- ৯]

  يَاأَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءَكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ كَثِيرًا مِمَّا كُنْتُمْ تُخْفُونَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَعْفُو عَنْ كَثِيرٍ  قَدْ جَاءَكُمْ مِنَ اللَّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُبِينٌ يَهْدِي بِهِ اللَّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلَام وَيُخْرِجُهُمْ  مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِهِ وَيَهْدِيهِمْ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ

অর্থাৎ, হে কিতাবীগণ! আমার রাসূল তোমাদের নিকট এসেছে, তোমরা কিতাবের যা গোপন করতে সে এর অনেক কিছু তোমাদের নিকট প্রকাশ করে এবং অনেক কিছু উপেক্ষা করে থাকে। আল্লাহর নিকট হতে এক আলোকবর্তিতা ও সুস্পষ্ট কিতাব তোমাদের নিকট এসেছে। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চায়, এটা দিয়ে তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পরিচালিত করেন এবং নিজ অনুমতিক্রমে অন্ধকার হতে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান এবং এদেরকে সরল পথে পরিচালিত করেন। [সূরা মায়িদা : ১৫, ১৬]

   مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْرًا كَثِيرًا وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلًا هُوَ الَّذِي يُصَلِّي عَلَيْكُمْ وَمَلَائِكَتُهُ لِيُخْرِجَكُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَكَانَ بِالْمُؤْمِنِينَ رَحِيمًا

অর্থাৎ, মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নন; বরং সে আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ। হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো এবং সকাল সন্ধ্যায় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো। তিনি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণও তোমাদের জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করে অন্ধকার হতে তোমাদেরকে আলোর পথে আনার জন্য এবং তিনি মুমিনদের প্রতি পরম দয়ালু। [সূরা আহযাব: ৪০-৪৩]

رَسُولًا يَتْلُو عَلَيْكُمْ آيَاتِ اللَّهِ مُبَيِّنَاتٍ لِيُخْرِجَ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَمَنْ يُؤْمِنْ بِاللَّهِ وَيَعْمَلْ صَالِحًا يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا قَدْ أَحْسَنَ اللَّهُ لَهُ رِزْقًا

অর্থাৎ, এক রাসূল, যে তোমাদের নিকট আল্লাহর সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ আবৃত্তি করে, যারা মুমিন ও সৎকর্মপরায়ণ তাদেরকে অন্ধকার হতে আলোতে আনার জন্যে। যে কেউ আল্লাহকে বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে তিনি তাকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে; আল্লাহ তাকে উত্তম রিযিক দিবেন। [সূরা তালাক: ১১]
মোটকথা, খ্রিষ্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে মানবসভ্যতা এমন এক সময় পার করছিল, যার সামনে ছিল না সুস্পষ্ট কোনো গন্তব্য, পথ চলার মতো সামান্য আলো। ব্যক্তি থেকে নিয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র কোথাও নীতি-নৈতিকতার কোনো বালাই ছিল না। ধর্ম, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি সবখানেই চলছিল শুধু অরাজকতা। প্রতিটি মানব সন্তান আত্মবিস্মৃত অবস্থায় কামনা আর প্রবৃত্তির গোলক ধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের কাছে আসমানী কোনো জ্ঞান ছিল না, নিজেদের খেয়াল-খুশি অনুযায়ী যার তার সামনে মাথানত করত। ঈসা আ. কে উঠিয়ে নেওয়ার পরপরই তার অনুসারীরা চরম মতানৈক্যে লিপ্ত হয়। সেন্টপলের কল্যাণে শেষ পর্যন্ত তা এক পৌত্তলিকায় রূপ নেয়। ইহুদিরা নিজেদের কাছে থাকা আসমানি জ্ঞানকে দুনিয়া কামানোর মাধ্যম বানিয়ে রেখেছিল। যার কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে স্থায়ীভাবে তাদের উপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেওয়া। পরবর্তী লাইনগুলোতে নবি মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. এর আগমনের পূর্বে পৃথিবীতে বিরাজমান অবস্থা অনুসন্ধান করার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।
আরবদের অবস্থা
জাহিলী আরব সমাজে কিছু উন্নত ও মহৎ গুণ পরিলক্ষিত হত। অসীম সাহসিকতা, স্বাধীনচিতা, সরলতা, উদারতা, বদান্যতা, একনিষ্ঠতা, আতিথেয়তা, কাব্যচর্চা, বাগ্মিতা, মহানুভবতা, আত্মসম্মানবোধ, গোত্রের প্রতি আনুগত্য প্রভৃতি মহৎ গুণরাজি সমাজের মানুষের মধ্যে লক্ষ করা যেত। শত্রুর সাথে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করত না। আশ্রিতজন শত্রু হলেও জীবনের বিনিময়ে তাকে রক্ষা করত। নিঃসন্দেহে এগুলো ছিল আরব চরিত্রে প্রশংসনীয় দিক।
কিন্তু নবীগণের শিক্ষা থেকে দূরে অবস্থান, দীর্ঘকাল যাবত একই উপদ্বীপে আটকে থাকা এবং বাপ-দাদার ধর্ম ও ঐতিহ্যকে শক্তভাবে আঁকড়ে থাকার কারণে ধর্মীয় ও নৈতিক দিক থেকে তাদের অবস্থান ছিল খুবই শোচনীয়। খ্রিষ্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে তারা অধঃপতনের চূড়ান্ত সীমায় উপনীত হয়। প্রকাশ্যে মূর্তীপূজায় লিপ্ত ছিল তারা এবং তারাই এর নেতৃত্ব দিত। মোটকথা, আল্লাহপ্রদত্ত জীবনের অধিকাংশ সৌন্দর্য থেকে তারা বঞ্চিত ছিল এবং জাহিলি জীবনের নিকৃষ্ট বৈশিষ্ট্যে ও দোষত্রুটিতে নিমজ্জিত ছিল।
মূর্তীপ্রীতি ও দেবদেবীর আধিক্য
অজ্ঞতা ও মূর্খতার নিশ্চিত ফল স্বরূপ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকে। আল্লাহর একত্ববাদ ও তার ইবাদাত বিশিষ্ট কিছু লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এক সময় তারা প্রকাশ্যে মূর্তীপূজা শুরু করে এবং তাদেরই সমীপে নিজেদের সকল ইবাদত ও প্রার্থনা পেশ করতে থাকে; যদিও তারা তখনও সৃষ্টিকর্তা হিসেবে আল্লাহকে স্বীকার করত। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন,وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ فَأَنَّى يُؤْفَكُونَ

অজ্ঞতা ও মূর্খতার নিশ্চিত ফল স্বরূপ সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক নষ্ট হতে থাকে। আল্লাহর একত্ববাদ ও তার ইবাদাত বিশিষ্ট কিছু লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এক সময় তারা প্রকাশ্যে মূর্তীপূজা শুরু করে এবং তাদেরই সমীপে নিজেদের সকল ইবাদত ও প্রার্থনা পেশ করতে থাকে; যদিও তারা তখনও সৃষ্টিকর্তা হিসেবে আল্লাহকে স্বীকার করত। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন,

অর্থাৎ, যদি তাদের জিজ্ঞাসা করা হয় আসমান ও জমিন কে সৃষ্টি করেছে, তবে অবধারিতভাবেই তারা বলবে, ‘আল্লাহ’। [সুরা আনকাবুত : ৬১]
কিন্তু সৃষ্টিকর্তার সাথে তাদের আত্মিক কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাদের সম্পর্ক হয়েছিল তাদেরই হাতে গড়া মূর্তীগুলোর সাথে। আরবে প্রতিটি নগর, বন্দর ও শহরে, এমনকি প্রতিটি পরিবারে বিশেষ বিশেষ মূর্তী ছিল। ঐতিহাসিক কালবি বলেন, ‘মক্কার প্রতিটি ঘরে একটি নিজস্ব মূর্তী ছিল। কেউ ভ্রমণের ইচ্ছা করলে তার সর্বশেষ কাজ ছিল ঘরের মূর্তী স্পর্শ করা। আবার সফর থেকে ফেরার পরও ভক্তিভরে ওই মূর্তীর পা স্পর্শ করা।’
মূর্তীর ক্ষেত্রে তারা এতটাই বাড়াবাড়ি করত যে, কেউ বানাত মূর্তী আবার কেউ বানাতো মূর্তীর ঘর। আর যে ব্যক্তি কোনোটিই বানাতে পারত না, সে হারামের সামনে বা ভিন্ন কোথাও একটি পাথর গেড়ে কাবার মতো সম্মানের সাথে -তাওয়াফ করতে থাকত। এ সকল পাথরকে তারা ‘আনসাব’ বলত। খোদ কাবা শরিফের প্রাঙ্গনে ৩৬০টি মূর্তী রক্ষিত ছিল। মূর্তীপূজায় তারা এতটাই বুঁদ হয়ে ছিল যে, পাথর জাতীয় কিছু একটা পেলেই তার পূজা করা শুরু করত।
ইমাম বুখারী রাহ. তাঁর সহিহ গ্রন্থে আবু রজা আল উতারিদি থেকে বর্ণনা করেন, ‘আমরা পাথর পূজা করতাম। তার চেয়েও ভালো ও উন্নত কোনো পাথর পাওয়া গেলে আগেরটা ছুড়ে ফেলা হতো। আর কখনো কোনো পাথরই না পাওয়া গেলে একটি মাটির ঢিবি বানানো হতো এবং ছাগল এনে সেখানে দুধ দোহন করা হতো। এরপর তা তাওয়াফ করা হতো।’
ইবনুল কালবি বলেন, ভ্রমণকালে কোনো লোক নতুন জায়গায় অবতরণ করলে সেখান থেকে চারটি পাথর উঠিয়ে আনত। সবচে ভালোটিকে উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করত। আর বাকি তিনটি রাখত হাঁড়ি বসিয়ে রান্নার জন্য। প্রস্থানের সময় ওগুলো সেখানেই ফেলে যেত।
এছাড়াও তাদের দেব-দেবীর সংখ্যা ছিলো অনেক। ফেরেশতা, জিন, নক্ষত্র সবই এর শামিল ছিল। ঐতিহাসিক কালবি বর্ণনা করেন, খুজাআ গোত্রের একটি শাখা ছিল বনু মালিহ। তারা জিনদের পূজা করত। সা‘দ বর্ণনা করেন, হিময়ার গোত্র সূর্যের পূজা করত। কিনানা গোত্র চাঁদের পূজারী ছিল। বনু তামিম ওয়াবরানের, লাখম ও জুযাম বৃহস্পতির, ত্বই গোত্র সুহায়ল-এর, বনু কায়স শে’রা নক্ষত্রের এবং বনু আসাদ বুধ গ্রহের পূজা করত।

চলবে…

Share: